Last Updated on January 13, 2025 by কর্মসংস্থান ব্যুরো
স্বামী বিবেকানন্দ, যাঁর বাণী আজও আমাদের জীবনে প্রাসঙ্গিক, তিনি শুধু একটি ধর্ম বা জাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলেন না। তাঁর দর্শন বিশ্বমানবতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও সমবেদনা প্রদর্শন করেছিল। হিন্দুধর্ম, ইসলামের মেলবন্ধন, গৌরক্ষা, এবং দেশপ্রেমের একাধিকারী মিশেল তার দর্শনে ছিল। তার বিশ্বাস ছিল যে মানুষের সঠিক পথপ্রদর্শক হতে হলে সেই পথটি মানবতার প্রতি সহানুভূতির ভিত্তিতে হতে হবে।
হিন্দুধর্মের অন্তর্নিহিত বৈচিত্র্য
স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, “হিন্দুধর্ম কোনো নির্দিষ্ট বিধি বা আইন অনুসরণ করে না, বরং এটি বৈচিত্র্যে একতার চেতনা প্রতিষ্ঠা করে।” তিনি উল্লেখ করেছেন যে, হিন্দুধর্ম বিশ্বের সর্বোচ্চ মানবাধিকার ও শ্রদ্ধা নিয়ে পথ প্রদর্শন করে, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই সমাজের কিছু অসৎ ব্যক্তি হিন্দুধর্মের বাণীকে অন্যভাবে উপস্থাপন করেন, যার ফলে কিছু ভুল ধারণা সৃষ্টি হয়।
তিনি সেগুলির সমালোচনা করেছিলেন এবং বলেছিলেন যে, “ধর্ম কখনোই মানুষকে অত্যাচার করতে শিখায় না, কিন্তু কিছু ভণ্ড পুরোহিত বা সমাজের অংশ বিশেষ ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিতে পারে।”
ইসলাম ও হিন্দুধর্মের মিলিত সংস্কৃতি
স্বামী বিবেকানন্দের মতে, “হিন্দুধর্মের বুদ্ধিদর্শন (ভেদান্ত) এবং ইসলামের মানবিকতা একত্রিত হলে ভারত এবং পৃথিবীকে একটি নতুন দিশা প্রদর্শন করতে পারবে।” তিনি বিশ্বাস করতেন যে, দুই ধর্মের মধ্যে সম্মান ও সহাবস্থান সম্ভব, যা একমাত্র দেশে শান্তি এবং উন্নতি আনতে পারে।
ইসলামের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ছিল, কারণ ইসলাম ধর্মেও ভেদবুদ্ধির চেয়ে মানবতার প্রতি ভালোবাসা ও সহানুভূতির গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল। এই কারণেই তিনি বলেছেন, “যতটা ভগবানকে আমাদের মধ্যে দেখার চেষ্টা করবো, ততটা শান্তি এবং মৈত্রী লাভ হবে।”
গৌরক্ষা: মানবতার সেবা
স্বামী বিবেকানন্দের কাছে গৌরক্ষা (গরুর সুরক্ষা) একটি বড় বিষয়ের মধ্যে ছিল, তবে তিনি এ নিয়ে কিছু আপত্তিও তুলেছিলেন। তাঁর কথায়, গৌরক্ষার নামে মানবতার প্রতি উদাসীনতা বা অন্যদের দুঃখকষ্টকে অগ্রাহ্য করা ভুল। একবার তিনি গৌরক্ষকদের একটি সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছিলেন, “আপনি যখন গরু রক্ষা করছেন, তখন আপনার দৃষ্টি তো মানুষ, বিশেষ করে দরিদ্রদের দিকে হবে না কেন? মানুষ ক্ষুধার্ত, অসুস্থ, অশিক্ষিত—এদের সেবা করা তো প্রথম দায়িত্ব।”
তিনি বলেন, “মানুষকে প্রথমে শিক্ষিত করতে হবে, তাদের আধ্যাত্মিক এবং শারীরিক উন্নতির দিকে মনোযোগ দিতে হবে। যখন মানুষ সমাজে সম্মান পাবে, তখন সমাজের উন্নতি হবে।”
দেশপ্রেম: শুদ্ধ মানবিক অনুভূতি
স্বামী বিবেকানন্দের কাছে দেশপ্রেম ছিল একেবারেই মানবিকতা এবং দরিদ্রের প্রতি সহানুভূতির বিষয়। তিনি বলেছেন, “যে জাতি দুর্বল, যে জাতির মানুষের প্রতি দয়া নেই, সেই জাতি কখনো উন্নতির দিকে এগোতে পারে না। প্রথমে মানুষের দুঃখ-কষ্টে সহানুভূতিশীল হতে হবে, তারপর দেশপ্রেম আসবে।”
তিনি বিশ্বাস করতেন যে, “প্রকৃত দেশপ্রেম তখনই সম্ভব, যখন মানুষের মধ্যে অশিক্ষা, দারিদ্র্য এবং অজ্ঞানতার অবসান হবে।” দেশপ্রেমের প্রকৃত মানে শুধু জাতীয়তাবাদে সীমাবদ্ধ নয়, বরং প্রতিটি ভারতীয় নাগরিকের মঙ্গল কামনা করা, তাদের শিক্ষিত ও উন্নত করতে কাজ করা।
শিক্ষার গুরুত্ব: অধিকারী সমাজ নির্মাণের ভিত্তি
স্বামী বিবেকানন্দ বলেন, “শিক্ষা হলো শক্তির মূল উৎস। একটি জাতি তখনই উন্নতি করতে পারে যখন তার প্রতিটি নাগরিক শিক্ষা লাভ করবে।” তাঁর মতে, গরীব ও অবহেলিতদের জন্য শিক্ষা প্রদান হলো সবচেয়ে বড় সেবা। তিনি বলেন, “শিক্ষিত না হলে দেশ কখনো প্রকৃতভাবে এগোতে পারবে না।”
শিক্ষা মানুষের মনের গভীরে পরিবর্তন আনতে সক্ষম। যখন একজন মানুষ নিজেকে শিক্ষিত মনে করে, তখন তার মধ্যে আত্মবিশ্বাস, সামর্থ্য এবং সম্ভাবনা দেখা দেয়। তখন সে সমাজের উন্নতির জন্য কাজ করতে সক্ষম হয়।
উপসংহার: মানবতার দিকে ধাবিত এক যুগান্তকারী চিন্তাভাবনা
স্বামী বিবেকানন্দের জীবন ও দর্শন আজও আমাদের প্রেরণা দেয়। তাঁর চিন্তাভাবনা আমাদের জানায় যে, ধর্ম, জাতি, এবং সংস্কৃতি যতই ভিন্ন হোক না কেন, আমাদের মূল উদ্দেশ্য হলো মানবতা ও সহানুভূতি। হিন্দুধর্ম, ইসলাম, গৌরক্ষা, দেশপ্রেম—এই সবকিছুই তাঁর জীবন দর্শনের অনিবার্য অংশ, যা আজও আমাদের জীবনে এক নতুন দিশা প্রদর্শন করে।